পটুয়াখালীর গণহত্যা

0
2879

স্বাধীনতা, সে আমার স্বজন হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন

আসামী : মেজর নাদের পারভেজ, মেজর ইয়ামিন, ক্যাপ্টেন মুনির হোসেন, গুল বাদশা, হাবিলদার শাহাদৎ হোসেন।

অপরাধের ধরণ : গণহত্যা, জাতিগত নিধন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগিড়বসংযোগ।

সাক্ষী : রবীন্দ্রনাথ হালদার, বাদল ব্যানার্জী, সুভাষ চন্দ্র রায়, শামসুল হক, দুলাল চন্দ্র সাহা

ঘটনাকালঃ একাত্তরের ছাব্বিশে এপ্রিল থেকে স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত।

ঘটনাস্থল: পটুয়াখালী

সূত্র: যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ এবং WCFFC গবেষণা।

একাত্তরের ছাব্বিশে এপ্রিল পাকি বাহিনী পটুয়াখালী আμমণ করে গণহত্যা শুরু করে। তাদের হাতে আনসার বাহিনীর অনেক সদস্য নিহত হয়। হত্যাযজ্ঞের শিকার অনেককে তাঁদের আত্মীয় স্বজনরা নিয়ে দাফন করে। আবার অনেক লাশ মাতব্বর বাড়ির গণকবর, কালিকাপুর তুলাতলীর গণকবরে দাফন করা হয়। আনসারদের দাফন করা হয় জেলা প্রশাসকের বাসভবনের দক্ষিণ পাশের গণকবরে। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী দিনগুলোতে পাকি হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদররা শত শত লোককে ধরে এনে পুরাতন জেলখানার অভ্যন্তরে হত্যা করে। একেকটি কবরে আট দশটি করে লাশ বিনা জানাজায় দাফন করা হয়।

পটুয়াখালী জেলখানার ভেতরেও গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। এখানকার প্রতিটি গর্তে চার পাঁচ জন করে মানুষের লাশ পুঁতে রাখা হয়েছিল।জেলের ভেতরে প্রায় পাঁচ শ’ বন্দীকে গুলি করে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হয়। জেলখানার প্রাচীরগুলোর গায়ে এখনও বুলেটের চিহ্ন বিদ্যমান। মেজর নাদের পারভেজের নির্দেশে একদিনে জেলের ভেতর ষাট সত্তর জনকে হত্যা করা হয়। পটুয়াখালী মাতব্বর বাড়ি, কালিকাপুর এবং জেলা প্রশাসকের বাসভবনের দক্ষিণ পাশেও রয়েছে গণকবর। পাকি বাহিনীর উপরিউক্ত আর্মি অফিসারগণ সরাসরি এসব হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল।

বাদল ব্যানার্জী বলেন, পঁচিশ মার্চের গণহত্যার ঠিক এক মাস পর অর্থাৎ ছাব্বিশে এপ্রিল পাকি বাহিনীর তিনটি পেন পটুয়াখালীতে আসে।পেন গুলো পটুয়াখালীতে এসে অবিরাম শেলিং শুরু করে। এক ঘন্টা গুলি বর্ষণের পর পেন তিনটা চলে যায়। ঠিক আধাঘন্টা পরে ওই পেন তিনটি দু’টি হেলিকপ্টারসহ ফিরে এসে পুনরায় শেলিং শুরু করে। মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা দু’একটা গুলি ছুঁড়লেও তা বিমান ধ্বংস করার মত কিছু ছিল না। কারণ তখন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র বলতে তেমন কিছুই ছিল না। মাতবর বাড়ির কাছে হেলিকপ্টার থেকে পাকি সেনারা নামে। নামার পরপরই তারা দু’টো গ্র“পে ভাগ হয়ে একটা জৈনকাঠীর দিকে অপরটি জেলা প্রশাসকের বাড়ির দিকে যায়। জৈনকাঠীর দিকে যে গ্র“পটা যায়, তারাই বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটায়। কারণ মানুষজন তখন আর্মির ভয়ে ওই দিক দিয়েই পালাচ্ছিল। কিন্তু সামনে খাল থাকায় লোকজন সেটা পার হতে পারেনি। সে সময় খালে জোয়ার ছিল। এ অবস্থায় যাকে যেখানে পায়, বর্বররা গুলি করে হত্যা করে। ছাব্বিশে এপ্রিল সন্ধ্যায় এই ঘটনা ঘটে। ওই দিন তারা আড়াই হাজার লোককে হত্যা করে। আমরা সেদিন নিহতদের তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম। তাছাড়া ঐ হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে আসা কিছু লোক আমার বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের কাছ থেকে আমি তথ্য সংগ্রহ করি। ওই রাতে গানবোটে করে আর্মির আরও একটি গ্র“প পটুয়াখালীতে আসে। কারা এসেছিল, তাদের নাম বলতে পারব না। তবে এখানে ছত্রী সেনার একটা ট্রুপ ছিল এবং নাদের পারভেজের নেতৃত্বে অন্য আর একটি দল ছিল। এদিন দুপুরে যে দলটি ডিসি আওয়াল সাহেবের বাসার দিকে যায়, তারা ডিসিকে দেখে হাত তুলতে বলে। ডিসিকে তারা চিনত না। ডিসি সাহেব হাত তোলার পরেও তারা তাঁর কোমরে গুলি করে। পাকি সেনারা ডিসিকে চিনতে পারেনি। গুলির পর ডিসিকে চিনতে পেরে তারা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করায়। সেদিন যাদেরকে হত্যা করা হয়, তাদের সবাইকে বিচ্ছিনড়বভাবে মাটিচাপা দেওয়া হয়। কারও কারও লাশ নদীর স্রোতে ভেসে যায়। পটুয়াখালীর মাতবর বাড়ির কাছে সতেরো জনের একটা গণকবর আছে। পুরনো জেলখানার ভেতর বড় বড় তিনটি গণকবর আছে। এছাড়া নতুন জেলখানার পাশে আনসার বাহিনীর সাত জনের একটি গণকবর আছে। জেল খানার ভেতরে চার পাঁচ শ’ লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়। সে সময় জেলখানার ভেতরে ও অন্যান্য গণকবর থেকে যে সমস্ত লাশ তোলা হয়, সেখানে মহিলাদের অনেক চুল পাওয়া যায়।

.

পটুয়াখালীর জেলখানায় প্রথম দিন পাকি বাহিনী একটি কামরায় এক শ’ পঞ্চাশ জনের মত মহিলাকে বন্দী করে রাখে। এই মহিলাদের দিনের পর দিন নির্যাতন করা হয়। আমি অনেককেই চিনি কিন্তু নাম বলতে পারব না। পটুয়াখালী সদরেই আছে পঁচিশ জনের মত বীরাঙ্গনা। একজন প্রফেসরের স্ত্রী আছেন, যিনি সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তরে চাকরি করেন। অন্য একজন আছেন নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে। নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের ওই মহিলা পাকিস্তানি আর্মির ধর্ষণের ফলে গর্ভবতী হয়ে পড়েন। সেই কন্যা সন্তানকে তিনি এম.এ. পাস করিয়েছেন। তার ভাল বিয়েও হয়েছে। সে এখন ঢাকায় চাকরি করে।

জেলখানার ভেতর গুলি খেয়ে একটি লোক কচু গাছের ভেতরে গিয়ে লুকায়। সেখান থেকে গোঙানির শব্দ শুনে রুস্তম নামে এক পাকি দালাল তাকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। একাত্তরের নয় মাসে পটুয়াখালীতে প্রতিদিন গড়ে বিশ পঁচিশ জনকে হত্যা করা হয়। গলাচিপা থানায় একদিনে একত্রিশ জন, ছোট বিঘায় একদিনে সাত জন, চিকনিকান্দি ও অন্যান্য এলাকায় প্রতিদিন এভাবে মানুষ হত্যা করা হত। নয় মাসে এখানে সাত আট হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছে। লোয়ালিয়া, কালিকাপুর প্রভৃতি এলাকায় অনেকগুলো নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। আমাদের এখানকার ট্রেজারি অফিসার মি. দত্তের স্ত্রীকে নাদের পারভেজ রক্ষিতা করে রেখেছিল।

রবীন্দ্রনাথ হালদার বলেন, একাত্তরের ছাব্বিশে এপ্রিল পাকি বাহিনী প্রথম পটুয়াখালী আসে। সেদিন আমি, বাদল ব্যানার্জী, সাহেদ উলাহ্, নূর হোসেন, আলম ও রেজাউল হোসেন যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য রাইফেল আনতে থানায় যাই। হঠাৎ শব্দ শুনে দেখি, আকাশে দু’টো যুদ্ধ বিমান উড়ছে। থানার কন্ট্রোলরুম তখন বন্ধ ছিল। তালা ভেঙে শুনলাম টেলিফোনের রিং বাজছে। ফোন তুলে শুনি পেন থেকে এক্সচেঞ্জকে বলছে থানায় পাকিস্তানি পতাকা ওড়াতে। সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি আবুল কাশেমকে ফোন করে একথা জানালে তিনি আমাদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে বলেন। তখন আমরা তালা ভেঙে থানার মজুদ অস্ত্রগুলো নিয়ে নেই। রাইফেল নিয়ে লাউকাঠি নদীর পাড়ে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই ছত্রীসেনা নামতে শুরু করে। পেন ল্যান্ড করার পর আμমণের প্যান করা হয়। কিন্তু পাকি বিমানবাহিনী ল্যান্ড না করে বোম্বিং শুরু করে। আমরা সেখান থেকে নৌকা করে অন্যত্র চলে যাই। আমাদের নৌকা লক্ষ্য করে শেল নিক্ষেপ করা হয়। তখন আমরা মৌকরণ থেকে আঙ্গারিয়া যাচ্ছিলাম। সন্ধ্যার পর আঙ্গারিয়া থেকে আমরা দেখতে পাই যে, সমস্ত পটুয়াখালী শহরে আগুন জ্বলছে।

পটুয়াখালীর পুরান বাজার এবং বণিক পট্টি পুড়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। প্রথম দিনেই সেখানে কয়েক শ’ লোক মারা যায়। রাজাকার মশুমিয়া ও মহিউদ্দিনসহ অন্যান্য রাজাকার পাকি আর্মির বিকৃত লালসা চরিতার্থ করার জন্য বাঙালি মেয়েদেরকে ধরে আনত। নাদের পারভেজ এখানকার ট্রেজারি অফিসার মি. দত্তের স্ত্রী ও শ্যালিকাকে জোরপূর্বক রক্ষিতা হিসেবে ব্যবহার করে। এছাড়া বিভিনড়ব গ্রাম থেকে নাদের পারভেজের মনোরঞ্জনের জন্য মেয়েদের ধরে আনা হত।

রবীন্দ্রনাথ হালদার আরো বলেন, দশ বারোটা ভদ্র পরিবারের নির্যাতিত মহিলাকে তিনি চেনেন। কিন্তু নিরাপত্তা ও সম্মানের কথা ভেবে তাদের পরিচয় দেননি। তবে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে বীরঙ্গনারা যাতে সমাজে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে, সে জন্য সবাই তাঁদেরকে সহযোগিতা করেন। বীরাঙ্গনাদের একজনের আজও বিয়ে হয়নি। তিনি চাকরি করতেন, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। একাত্তরে ওই মহিলার পুরান বাজারের বাসাটিকে পাকি আর্মি রংমহল বানিয়েছিল। পাকি বাহিনী সেখানে বহু নারীকে ধরে এনে সম্ভ্রমহানি করে। গলাচিপাসহ বিভিনড়ব অঞ্চল থেকে হিন্দু মুসলিম সব ধর্মের মহিলাদেরই ধরে আনা হত। পাকি আর্মি শহরের মহিলাদের হত্যা না করলেও গ্রামের অনেক মহিলাকে হত্যা করে। রেনু নামের একজন পাগল মহিলাকেও পাকিরা হত্যা করে। শহরের ভদ্র পরিবারের মহিলারা লজ্জায় অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোন কেস করেননি।

রবীন্দ্রনাথ হালদার বলেন, পটুয়াখালীতে তিনটি গণকবর আছে। ২৬ মে মাতব্বর বাড়িতে বহু লোককে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হয়।ডিসির বাসার সামনে এবং জেলখানার ভেতর রয়েছে বাকী দুটো গণকবর। চিকনি কান্দিতেও একটি গণকবর আছে বলে তিনি জানান।

দুলাল চন্দ্র সাহা বলেন, পঁচিশ মার্চের এক মাস পর পাকি বাহিনী পটুয়াখালী আসে। পাকি ছত্রী বাহিনী নামার পর আমি সাঁতরিয়ে নদী পার হয়ে পর হাউলিয়াপুর এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাই। সেখানে আমার মা বাবাও আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্রায় আট নয় দিন পর তাঁদের সাথে আমার সাক্ষাৎ ঘটে। নদী পার হওয়ার সময় আমি কয়েকজনের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছিলাম।

দুলাল চন্দ্র পাকি বাহিনীর হাতে তাঁর বাবার বন্দী হওয়ার ঘটনা বলতে গিয়ে জানান, পাকি বাহিনী আমতলী থেকে আমার বাবাকে ধরে এনে নির্যাতন করে। গুলি করার কথা থাকলেও শান্তি কমিটির দু’জন সদস্য বাবার পরিচিত ছিল বলে দয়া করে বাবাকে তারা ছেড়ে দেয়। বাবাকে ছেড়ে দিলেও তাঁর কোন খোঁজ খবর পাচ্ছিলাম না আমরা। তবে আমি সেখানে থাকিনি। দু’একদিনের মধ্যেই সেখান থেকে পটুয়াখালী চলে আসি। বাসায় এসে দেখি, ঘরের দরজা জানালা সব ভাঙা। জিনিসপত্র লুটপাট করে নিয়ে গেছে। তবে বাবা বাসাতেই ছিলেন। আমি ও বাবা কোনমতে রাতটা কাটানোর পর, সকালে পাকিবাহিনী এসে আমাকে ধরে নিয়ে যায়।

পাকি বাহিনীর নৃশংস নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রথমে আমাকে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। দু’ঘন্টা পর থানায় নিয়ে মুক্তি বাহিনীতে কবে যোগদান করেছি, রাজশাহীতে ট্রেনিং নিয়েছি কি না, মুক্তিযোদ্ধা কে কে আছে, এসব জিজ্ঞাসা করতে থাকে। জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি ভয়ংকর নির্যাতন করতে থাকে। সেদিন আমার সাথে থানায় আরও চার জন ছিলেন। পরদিন সকালে আমাকে সার্কিট হাউজে নিয়ে আবারও অমানুষিক নির্যাতন করে। সেখানে চেয়ারে বসিয়ে সমস্ত শরীরে লাঠি দিয়ে পেটায়। রোলার দিয়ে হাঁটুতে, পায়ে, পিঠে, হাড়ে হাড়ে আঘাত করে, আঙুল মেঝের উপর রেখে রাইফেলের বাঁট দিয়ে থেঁতলে দেয়। নির্যাতনের ফলে অনেক বার আমি অজ্ঞান হয়েও পড়েছি। তিন দিন পর আমাকে মেজর নাদের পারভেজের কাছে নিয়ে গেলে, আমি মেজরকে বলি যে, আমি নির্দোষ, আমাকে ছেড়ে দিন। সেদিন নাদের পারভেজের সাথে পাকি বাহিনীর এদেশীয় দোসর মোতাহার, সলিমুলাহ, বিহারি খান, শামসু, তোফা মিয়া এদেরকে দেখতে পাই। নাদের পারভেজ আমাকে বলে তুম মুক্তিবাহিনী, তুম দেশ বাংলাকা মুক্তিসেনা- ইসকো জেলমে ভেজ দো, আচ্ছা করকে মালিশ দো’। এরপর আমাকে জেলের এক সেলে নিয়ে আটকে রাখে। দুই দিন ধরে রোলার, রাইফেলের বাঁট দিয়ে মেরে শরীরের বিভিনড়ব অংশ ফাটিয়ে দেয়। এতে আমার পিঠে বড় বড় দাগ হয়ে যায়।

জেলখানায় অন্য বন্দীদের ওপর নির্যাতন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিনদিন পর সেল থেকে আমাকে হল রুমে নিয়ে যাওয়ার পর সেখানে আমার চোখের সামনেই তিন চার জনকে হত্যা করা হয়। প্রথমে তালিকা অনুযায়ী নাম ডেকে তাদেরকে অন্য একটা কক্ষে নিয়ে রাখে। বিকাল পাঁচ/ছ’টার দিকে আর্মি এসে তাদেরকে জেলখানার ভেতরের গাছের কাছে দাঁড় করিয়ে পিঠে গুলি করে। পাশেই গর্ত করা ছিল। গুলি করার পর লুটিয়ে পড়লে, অর্ধমৃত অবস্থায় তার পা ধরে ওই গর্তে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হত। কেউ কেউ আধমরা অবস্থায় ছটফট করে কাতরাতে কাতরাতে মারা যেতেন। আমাকেও তিন চার বার নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সৌভাগ্যবশত তাদের গুলি আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে চলে যাওয়ার তারা আমাকে দ্বিতীয়বার গুলি করেনি। যাদের গুলি করে হত্যা করা হয়, তাদের মধ্যে পাথরঘাটার মজিবর রহমান ও তাঁর ছেলেকে আমি চিনতাম।আমি দু’মাস সেখানে বন্দী ছিলাম। দু’মাসে প্রায় এক শ’ জনকে হত্যা করতে দেখেছি আমি। অত্যাচারের ফলে আমি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ি। হাড়গোড় সব ভেঙে যায়। পায়খানা ও প্রস্রাবের সাথে রক্ত যেত। কখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারব সেটা কল্পনাই করতে পারিনি।

নারী নির্যাতন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জেলখানার ভেতরে মেয়েদেরকে আলাদা অংশে রাখা হত। সরাসরি নারী নির্যাতন না দেখলেও সেখান থেকে বহু মহিলাকে কাপড় ঠিক করতে করতে বেরিয়ে আসতে দেখেছি। মহিলাদেরকে আর্মি টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে যেত। আমি ঐসব মেয়েদের আর্তচিৎকার শুনতে পেতাম। সেখানে বিশ জনের মত মহিলা বন্দী ছিলেন বলে মনে হয়। তবে কোন মহিলাকে আমি গুলি করে হত্যা করতে দেখিনি। পটুয়াখালী জেলখানায় তখন মেজর নাদের পারভেজ ও ক্যাপ্টেন মুনির হোসেন ছিল। শাহাদৎ হোসেন নামে একজন হাবিলদারও ছিল। আগস্ট মাসে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য বেছে বেছে চার পাঁচ জন বন্দীকে মুক্তি দিলে আমিও তাদের সাথে মুক্তি পাই। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে প্রাণের ভয়ে পরিবারের সাথে বঙ্গোপসাগরের কূল দিয়ে ভারতের বাসন্তী ক্যাম্পে গিয়ে উঠি। সেখান থেকে সল্ট লেকের ক্যাম্পে গেলেও চিকিৎসার জন্য আমাকে হাসপাতাল থাকতে হয় অনেকদিন। এরপর দেশ স্বাধীন হলে আমি বাড়িতে ফিরে আসি। পটুয়াখালীতে পাকি বাহিনী আনুমানিক এক হাজার পাঁচ শ’ নিরীহ লোককে হত্যা করেছে বলে আমার ধারণা।

সুভাষ চন্দ্র রায় বলেন, তখন খুব কঠিন অবস্থার মধ্যে দিন কাটিয়েছি। যখন আকাশ পথে হামলা হল তখন আমরা নদী পার হয়ে লাউকাঠিতে চলে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে শুনেছি যে, আমার বয়সী ছেলেদেরকে আর্মি ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করছে। এই কথা শোনার পর আমি আর শহরে ফিরে আসিনি।

পরে আমি বাকেরগঞ্জে গাড়ড়িয়া গ্রামে আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিই। একদিন সকালে আর্মি এসে গাড়ড়িয়া গ্রামটি তছ্নছ্ করে দেয়। আর্মি সেখানকার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং গুলি করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে একুশ জনকে হত্যা করে, পুকুরে ফেলে দেয়। সেখানে হালদার ও কবিরাজ বাড়ির লোকজনও মারা যায়। আর্মির গুলিতে চার পাঁচটা গরুও সেদিন মারা যায়।এই ঘটনার পর আমি সেখান থেকে চলে যাই। আমি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পটুয়াখালীর বাইরে ছিলাম। সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তান সরকার একটি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। আমার বাবা তখন কাপড়ের ব্যবসা করতেন। বাবা শহর থেকে আসার পর পাকি আর্মি জিজ্ঞাসা করে, আপনার ছেলে কোথায়? যদিও আমরা চার ভাই ছিলাম, কিন্তু তারা বিশেষভাবে আমাকেই খুঁজছিল। কারণ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে বার এমএ পরীক্ষা দিয়েছিলাম। ওরা বারবার আমার জন্য বাবাকে চাপাচাপি করতে থাকে। বাবা তখন বাধ্য হয়ে আমাকে চলে আসতে বলেন। মা, ছোট ভাইবোন ও বাবার জীবনের দিকে চেয়ে আমি পটুয়াখালীতে ফিরে আসি। ফিরে আসার পর দশ দিন কোন সমস্যা হয়নি। আমরা ভালই ছিলাম। দশ দিন পর আমাদের এলাকায় সোনালী ব্যাংকের কাছে একটি বোমা বিস্ফোরিত হলে, সেই রাতেই আমাকেসহ আমার তিন ভাই ও বাবাকে পাকি আর্মি ধরে নিয়ে জেলে আটকে রাখে। আনোয়ার হোসেন নামে একজন আমাদের সাথে জেলে ছিলেন। তাঁকে আমি দাদা বলে ডাকতাম। রাত তিনটায় ঘুমন্ত অবস্থা থেকে আমাদের জোর করে ধরে নিয়ে যায়। আমাদেরকে সেখানে লাইন করে বসিয়ে রাখে। দেড় থেকে দুই শ’ জন বন্দী ছিল সেখানে। জেলার সাহেব আমাদের উদ্দেশ্যে বলল, ওদের বসিয়ে রাখো, গুলি করো না।

আমরা যখন জেলখানায় যাচ্ছিলাম, তখন ইব্রাহিম খাঁ নামে এক বিহারির সাথে রাস্তায় আমাদের দেখা হয়। আমার বাবা তাকে বলেন যে, আমাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে দাদা। এই ইব্রাহিম শান্তি কমিটির সদস্য ছিল। সে জেলখানায় গিয়ে সেদিনের মতো আমাদের বাঁচায়। ওই দিন তারা কোন লোককে হত্যা করেনি। তবে বেয়নেট, রাইফেলের বাঁট দিয়ে শারীরিকভাবে অনেক নির্যাতন করে। আমাদেরকে ওরা ভিনড়ব ভিনড়ব ঘরে রাখে। এইভাবে কিছুদিন রাখার পর, পাতাবুনিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকি সেনার বড় একটি সংঘর্ষ হয়। সেখানে পরাজিত হয়ে পাকি ক্যাপ্টেন মুনির হোসেন জেলখানায় বন্দীদের ওপর নির্যাতন শুরু করে। আমাকেও তারা বুট দিয়ে লাথি মারে। বেয়নেট দিয়ে কানের পাশে খোঁচা মারে। সেই দাগ এখনও রয়েছে। আমি কোন মতে বেঁচে যাই। ভগবান আমাকে বাঁচিয়েছেন। এর মধ্যে আমার বাবা ও ভাইদেরকে ওরা ছেড়ে দেয়।

আমাকে রক্তাক্ত অবস্থায় জেলখানার ভেতরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। জেলখানার হাসপাতালে চিকিৎসাহীন অবস্থায় দশ দিন থাকি। আমার তখন জ্ঞান ছিল না। জ্ঞান ফিরলে ডেপুটি জেলার আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, এত দুঃখ কেন, মনে ক্লান্তি কেন, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছেন, ঘাবড়ে গেলে হয় নাকি? তারপর সেই বাঙালি ডেপুটি জেলার (তাঁর নাম মনে নেই) বললেন, উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই…। তাঁর কথায় আমি কিছুটা মনোবল ফিরে পেলাম। ভাবলাম, জেলখানায় আমাদের পক্ষের কিছু লোকও তাহলে আছে। হাসপাতালে আমার মতো আহত আরও বিশ জন ছিল। জেনারেল ইয়াহিয়া খান সেই সময় একটা ফরমান জারি করল যে, যারা নির্দোষ (তাদের দৃষ্টিতে) তাদেরকে ছেড়ে দাও। তখন বুদ্ধি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, আমার ভাইভা পরীক্ষার জন্য একটা চিঠি ইস্যু করানো হয়। যদিও আমার ভাইভা পরীক্ষা আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমার বাবা ভাইভা পরীক্ষার মিথ্যা টেলিগ্রাম জেলখানায় দেখিয়ে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেলেন।

জেলখানায় অবস্থানকালে আমি বেশ কিছু পাকি সেনার মুখোমুখি হই। এদের মধ্যে গুল বাদশা, ক্যাপ্টেন মুনির, মেজর নাদের পারভেজ, মেজর ইয়ামিন প্রমুখ উলেখেযাগ্য। এদের মধ্যে গুলবাদশা ছিল পশতু, সে একটু দয়ালু প্রকৃতির ছিল। জেলার দায়িত্বে ছিল নাদের পারভেজ। এই নাদের পারভেজের সময়ই আমরা ধরা পড়ি। খুব নিষ্ঠুর লোক ছিল সে। আমি ছাড়া পাই মেজর ইয়ামিনের সময়। নাদের পারভেজ চলে যাওয়ার পর ইয়ামিন এখানে আসে। ইয়ামিন নাদের পারভেজের চেয়ে একটু কম নির্মম ছিল। ক্যাপ্টেন মুনির, নাদের পারভেজ এরা এখানে খুবই অত্যাচার করেছে।

নারী নির্যাতন সম্পর্কে শুনেছি যে, জেলখানায় পাকিস্তানি সেনার মনোরঞ্জনের জন্য বিভিনড়ব জায়গা থেকে মেয়েদের ধরে আনা হত। আমি প্রায় পঁয়তালিশ দিন জেলখানায় বন্দী ছিলাম। আমাদের সেলের পেছনে পাঁচ ছয় জন মহিলা বন্দী ছিলেন। তাদেরকে দেখার কোন সুযোগ ছিল না। তবে জেলখানার পশ্চিম পাশ থেকে মেয়েদের আর্তচিৎকার শুনতাম। সেই সব নির্যাতিত মেয়েদের নাম এখন আর মনে পড়ে না। তবে আমাদের এলাকায় নারী নির্যাতনের বহু ঘটনা আছে।

মেজর নাদের পারভেজ, মেজর ইয়ামিন, ক্যাপ্টেন মুনির হোসেন, গুল বাদশা, হাবিলদার শাহাদৎ হোসেন প্রমুখ পাকিস্তানি আর্মি ও তাদের সহযোগীরা পটুয়াখালী জেলায় একাত্তর সালে সংঘটিত সকল গণহত্যা, জাতিগত নিধন, ধর্ষণ, অগিড়ব সংযোগ ও লুটতরাজের জন্য দায়ী।