আমার মাইকেল হওয়ার গল্প!

0
2146

১৭ আগস্ট, ২০১৬, বুধবার, সকালে পকেটশূণ্য অবস্থায় বাসা থেকে বের হচ্ছি। বউয়ের চিরায়ত চাহিদার রেকর্ড বেজে চলছে। মাছ-তরকারি কিছু নাই, বাসায়ও কোন টাকা নাই, বাজার দিয়া তারপর বাইরে যাও। বললাম, অসুবিধা নাই কি কি লাগবে এসএমএস দিও। মোবাইলেও টাকা নাই যে এসএমএস দিব…।

আমার বাসা টিকাটুলি অভয় দাস লেন। অফিস হাটখোলা, হাঁটাপথ। অফিসে ঢুকেছি, খানিক পরেই বাসার দারোয়ানের ফোন। ‘স্যার চাঁন্দাবাজ আইসে, হ্যাতেরা ১৫ হাজার ট্যাকা চায়, অনেক ঝামেলা করতেসে-মুখে কওন যায় না, কিছু একটা করেন।’ এরপর বউ’র ফোন, গলা অসম্ভব ভীত সন্ত্রস্ত, ‘ওরা নীচের কলাপসিপল গেট ভাঙতেসে, এরপরই দরজা ভেঙ্গে ঢুকবে। বাবুরা সবাই কান্নাকাটি করতেসে, টাকা না দিলে ওরা বাবুরে নিয়া যাবে…’। বউর মরাকান্নায় পাড়াশুদ্ধ সবাই এসে পড়েছে। কিন্তু কেউ কিছু করতে পারছে না।

বাড়ির সব ফ্ল্যাট মালিক, যারা বাসায় ছিল সবাই ম্যানেজ করার চেষ্টা করলো কিন্তু ব্যর্থ। অফিস থেকে ৩/৪ জনকে বাসায় পাঠালাম, পাড়ার উঠতি রংবাজদের পাঠালাম, স্থানীয় ডিশ/ব্রডব্যান্ডের কয়েকজন স্টাফ পাঠালাম, আমাদের ডিজিএম মাসুম মোল্লাকে পাঠালাম তারাও ব্যর্থ। খবর পেয়ে আমার এমডি দীপক’দা হন্তদন্ত হয়ে অফিসে আসলেন। তিনি আমাদের টেনশন কমানোর চেষ্টা করলেন। অফিসের একাউন্টসকে ফোন দিয়ে বললেন, ‘জলদি সুমনের বাসায় যাও, টাকা পয়সা যা চায় তাই দিয়ে বিপদ সামাল দাও।’ নিজেরে প্রথমবারের মত মাইকেল মনে হলো।

ওয়ারি জোনের ডিসি, আমার রাজনৈতিক সহযোদ্ধা নুরুল ভাই। কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি বদলি হয়ে ময়মনসিংহ চলে গেছেন। এই জোনে ঘনিষ্ঠ কেউ নেই। বাধ্য হলাম রাষ্ট্রীয় ডিজিটাল সাহায্য নিতে। নেট থেকে ওয়ারি থানার ওসির নাম্বার নিয়ে ফোন করলাম। ফোন ধরলেন এডিসি। মাই ডিয়ার টাইপের মানুষ মনে হলো। বললেন এখনই ফোর্স পাঠাচ্ছি, বাসার ঠিকানা জেনে আমাকে লাইনে রেখেই ওয়াকিটকিতে মোবাইল টিমকে নির্দেশ দিলেন ফোর্স নিয়ে আমার বাসায় যেতে। মাত্র দু’জন চাঁদাবাজ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো পুলিশও সফল হলো না। অবশেষে পুলিশের উপস্থিতিতে স্থানীয় কয়েকজনের মধ্যস্থতায় তিনহাজার টাকা চাঁদা দিয়ে মুক্তি মিলল। কিন্তু আমার বউ বাচ্চা বা কয়েকজন পড়শির ট্রমা এখনও কাটেনি।

এই অসীম ক্ষমতাধর চাঁদাবাজরা কারা, অনেকে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। কিন্তু সবাই ওদের কাছে জিম্মি। হ্যাঁ ওরা তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া। বাংলাদেশের মত রক্ষণশীল রাষ্ট্রে মোল্লাদের চরম বিরোধিতার পরও ২০১৩ সালের নভেম্বরে রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা যাদের তৃতীয় লিঙ্গের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে সাহসিকতার প্রমান রেখেছেন। তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি পাওয়ার পরের বছর ২০১৪ সালের ১০ নভেম্বর ‘হিজড়া প্রইড ডে’ উদযাপন করা হয়। তুমুল আপত্তির পরও প্রথমবারের মত সহস্রাধিক হিজড়া ঢাকার রাজপথে ঐদিন ‘প্রাইড মার্চ’ করে। ব্যক্তিগত ভাবে আমিও আমার ক্ষুদ্র অবস্থান থেকে এলজিবিটিদের (লেজবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার) অধিকার নিয়ে বেশ কয়েকবার অনলাইনে লিখেছি। ব্লগার অনন্ত বিজয়ের হত্যাকারীদের কয়েকজন হিজড়া যেভাবে পাকড়াও করেছিল সেই সাহসিকতার উদাহরণ টেনে হিজড়াদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য অনেকেই কথা বলেছি। কিন্তু কি আর করা, আমাকেও তো তারা মাইকেল বানালো।

হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গ একপ্রকারের যৌনপ্রতিবন্দী, সমাজের সবচেয়ে অচ্ছুত ও পরিত্যাক্ত জনগোষ্ঠি। এরা যেহেতু বিধাতা সৃষ্ট এক প্রকারের অসম্পূর্ণ মানুষ তাই ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবাই বিব্রত তাদের নিয়ে। উন্নত বিশ্বও যে তাদের যথার্থভাবে এডাপ্ট করতে পেরেছে তা ও নয়। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম হওয়ার কারণ নেই। আবহমান কাল ধরে হিজড়া কেন্দ্রিক কিছু সংস্কৃতি/সংস্কার (বা অপ সংস্কৃতি) আমাদের দেশেও প্রচলিত আছে। শৈশবস্মৃতি যতটুকু মনে আছে- কোন বাড়িতে যদি নবজাতক জন্ম নেয় পার্শ্ববর্তি হিজড়া সমাজ আনন্দ করতে চলে আসে ঢোল-বাদ্য নিয়ে। তারা নাচ-গান করে নবজাতককে আশীর্বাদ করে। গৃহস্থ খুশী মনে তাদের কিছু চাল, নারিকেল বা সামান্য কিছু অর্থও দেয়।
আমার বাসায় যেটি ঘটেছে তা প্রচলিত এই সামাজিক রীতিরই কলিযুগের সংস্করণ যার অনিবার্য বৈশিষ্ট্য হলো যতক্ষণ পর্যন্ত কাঙ্খিত পরিমান টাকা না পাবে ততক্ষণ পর্যন্ত জগতে যত প্রকারের অশ্লিল অঙ্গভঙ্গি ও আদিম খিস্তিখেউর আছে, হেরেগলা ছেড়ে দিয়ে তার সর্ব্বোচ্চ ব্যবহার তারা করতে থাকবে, যার সর্বনিম্ন কর্মযজ্ঞ হচ্ছে খিস্তি খেউরের তালেতালে, ঢোল-বাদ্য সহযোগে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবার সামনে পরিহিত বস্ত্র ক্রমান্বয়ে নিবারণ। আপনি যতই প্রতিপত্তিশালী হননা্ কেন আপনাকে আপোষে আসতেই হবে।

সমাজ পরিত্যাক্তা এই হিজড়ারা আগে শুধু ভিক্ষা করেই চলতো, এখন চলে চাঁদাবাজি করে। দোকন-পাঠ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন, বাসা-বাড়ি সব জায়গাতেই অশ্লিলতার হুমকী দিয়ে চাঁদা তোলে। পাড়া মহল্লায় ঘুড়ে ঘুড়ে বাড়ির বারান্দায় রোদ দেয়া নবজাতকের কাঁথা-কাপড় খুঁজতে থাকে। একাধিকবার রেকি করে তারপর ঢোল-বাদ্যসহকারে ফাইনাল হামলা করে। আমার বেলায়ও সেটি ঘটেছে, যদিও আমার শিশুর বয়স ৭ মাস পেরিয়েছে। প্রায় তিন ঘন্টার তান্ডবযজ্ঞের পর আমারমত হাড়কিপটে, দরিদ্র অধমের পকেট থেকে তিন হাজার টাকা নিয়ে চলে যাবার সময় আরেকটি অমানবিক ফাইজলামি তারা করে গেল। যাবার সময় আমার বাসার বৃদ্ধ দারোয়ান কে সবার সামনে ৫০০ টাকা দিয়ে গেল। বেচারা দারোয়ানের এবার চাকুরি যায় যায়।

সমাধানের পর এডিসি সাহেব আমাকে ফোন দিয়ে সান্ত্বনা দিলেন। বললেন- কী আর বলবো ভাই ওরাও তো মানুষ, আল্লাহ্ আমাদের মত ওদের সবকিছু দেয় নি। আমরাও চাইলে আসলে অনেক কিছু করতে পারি না। ওদেরকে থানা-পুলিশ করলে আরও বড় বিড়ম্বনা সইতে হয়।
পরদিন আমাদের ডিজিএম মাসুম মোল্লা জানালো, আমার বাসায় হামলার পর ঐদিনই তার বিল্ডিং-এ এই গ্রুপটি হামলা চালায়। তার পাশের ফ্ল্যাট থেকে নিয়ে যায় ১১ হাজার টাকা। পুলিশের ঐ একই টিম সেখানে উপস্থিত হয়েছিল। সফল অভিযান শেষে হিজড়া ও পুলিশ খুশিমনে একই দিকে চলে যায়। পরে আরো কয়েকটি ঘটনা শুনলাম, সদ্যজাত শিশুর ক্ষেত্রে ওদের স্ট্যান্ডর্ড রেট হচ্ছে ১৫ হাজার টাকা। উত্তরায় আমার এক বন্ধুর ফ্ল্যাট থেকে ১৫ হাজার টাকাই নিয়েছে। আমার অতি কর্মতৎপড়তা, আর্থিক টানাপোড়েন ও শিশুর বয়স সাত মাস হওয়ায় তিন হাজারে মুক্তি মিলেছে।

সুতরং পাঠক যারা আমার অসহায়ত্ব বুঝেছেন তাদের কাছে কোন সমাধান থাকলে জানাবেন, অন্যথায় আপনিও মাইকেল হবার প্রস্তুতি নিন।