নামাবলী বা নামের বলি

0
4456

এইচএসসি পরীক্ষা মাত্র শেষ হইসে। কলেজ বার্ষিকী লইয়া দৌড়ের উপর আছি। দ্যাশের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে আমার অষ্টপ্রহর ওঠা বসা। আমার সেই মহাব্যস্ত সময় এক সাংবাদিক আমার পিছ নিসে। তিনি বিখ্যাত একটি বিদেশী সংবাদ সংস্থায় কাজ করেন। মোটামুটি বড় মাপের সাংবাদিক। টিএসসির কবিতা পরিষদের রুমে আমারে একদিন পাকড়াও করলো। ‘কইলেন সুমন, তোমার সাথে একটু কথা আছে।’ কুদ্দুসের চায়ের দোকানে, টিএসসির দেয়ালে ঠ্যাস দিয়া আমারে একটা বাংলা ফাইভ সিগারেট অফার করলো। সিনিয়র স্মোকারদের মত ভাব লইয়া, কোন প্রকার সৌজন্যতা না দ্যাখাইয়া সিগারেটটা লুফে নিলাম, মেকি অভ্যস্ততার সুরে স্পর্ধিত আত্মবিশ্বাস লইয়া কইলাম- ‘ম্যাচ?’
ততদিনে সাংস্কৃতিক অঙ্গণের বরেণ্য, মেধাবী তরুণ তারকাদের আস্কারা পাইয়া স্মার্ট স্মোকার বনে গেছি। রুদ্র দা, রিটন ভাই, আমীরুল ভাই, সানি ভাই, শিমূল দা…..প্রমুখের বিশ্বস্ত চ্যালা আমি। তাদের অকুন্ঠ সমর্থনে টুকটাক কালচারাল রংবাজীও করি। যাইহোক কুদ্দুসের চা খাইতে খাইতে জিগাইলাম, ‘কন-কি এমন জরুরী কথা?’ বললেন, ‘সুমন আমি তোমার দু‘একটা লেখা পড়ছি। তুমি খুব ভালো লেখ। তোমার মাকে নিয়ে আমাকে একটা লেখা দিবে।’
প্রথম যৌবনের উত্তেজনায় কলেজে ভর্তি হইয়াই কয়েকটা দ্বিতীয় শ্রেণির পত্রিকায় গল্প-কবিতা ছাপানোর জন্য প্রাণন্তর চেষ্টা করতাম, অনেকটা সফলও হইসি। তাছাড়া একটি সাপ্তাহিকেরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, যদিও পড়ি ইন্টারমিডিয়েটে। নিজের প্রতিভার প্রশংসা পাইয়া অনেক কষ্টে উৎফুল্লতা চাইপা রাখসি! চরম বিনয়ী হইয়া বিশুদ্ধ উচ্চারণে কইলাম ‘কি যে বলেন না ভাইয়া, তাছাড়া আমার মা তো বিখ্যাত কেউ না, তার বিষয়ে লেখা দিয়ে কী হবে?’ ‘ওভাবে বলতে নেই সমুন, লেখা কবে দিবা কও?’ মহা মুস্কিল, আমার মা মফস্বলের বিএ ফেল একজন সাধারণ মহিলা, তাকে নিয়ে কী এমন লিখবো?
আমার চরিত্রে একটা খুবই নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য আছে ‘না’ বলতে না পারা। শিশুদের প্রতি হ্যাঁ বলুন, কিন্তু কৈশর বয়সে ‘না’ বলা শেখাটা যে কত গুরুত্বপূর্ণ মাঝ বয়স পার কইরা তা হাড়ে হাড়ে টের পাইতেসি। কইলাম ‘আচ্ছা ভাইয়া, বার্ষিকীটা বের করি, তারপর একটু ফ্রি হয়ে মাকে নিয়ে লিখবো।’ আরেকটা কথা ‘তোমার মাকে নিয়া প্রথম লেখাটা আমিই যেন সবার আগে পাই, অন্য কেউকে দিবে না।’ ‘ঠিক আছে ভাইয়া।’ বুঝলাম বাংলার সাধারণ মায়েদের নিয়ে তিনি বোধহয় কোন বিশেষ প্রকাশণা করবেন। এরমধ্যে দিন-মাস-বছর ঘুইড়া যায় মাগার আমি আর লেখতেসি না, তিনিও নাছেড়বান্দা, কোনভাবেই পিছ ছাড়তেসে না। তারে দ্যাখলেই পলাই। ৯২’ তে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণআদালত হইলো। রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল রাজপথ। রাজপথে আমরা ৭১ এর গন্ধ পাইলাম। কোন প্রোগ্রামই মিস করি না। তারপর বাধ্য হইয়া মাকে নিয়া একটা লেখা লেইখা ফেললাম, যার শেষ কথাটি এমন- ‘সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম তারাও কি আমার মা নন!’
লেখাটি একদিন সাংবাদিক বড়ভাই’র হাতে ধরাইয়া দেলাম। বেটার লেট দেন নেভার। লেখা পাইয়া তিনি বেজায় খুশি হইলেন। ও-বাবা! লেখা দেয়ার পর দেখি তিনি আমারে এড়াইয়া চলতাসে। একদিন তারে ধরলাম, ‘কি ভাই, এক বছর দাবড়াইয়া লেখা নিলেন, কিন্তু এখন দেখি আমারে দেইখাও দ্যাখেন না। কাহিনী কি? লেখা পছন্দ না হইলে ফেরত দেন।’ তখন যেহেতু কম্পিউটারে লেখার প্রচলন তেমন চালু হয় নায়, ফটোকপি ও করি নাই তাই আমার কাছে কোন ডুপ্লেকেট নাই। দেখি তিনি আমতা আমতা করেন, ‘না মানে হ্যাঁ…. সুমন হইসে কি লেখাটা খুবই ভালো হইসে, ছোট একটু ঝামেলা আছে, আমি তোমারে পরে জানাবো’, বইলা কাইটা পড়লো। ও মা! তারও দেখি বছর ঘোরে আর আমারে দেখলেই তিনি এখন উল্টা পলান।
এবার আরেকটু পিছে যাই। ফাস্ট ইয়ার, সাংস্কৃতিক অঙ্গন দাপাইয়া বেড়াই। ৯০’র আন্দোলন তখনও দানা বাঁধে নায়, সংস্কৃতি, রাজনীতি, আড্ডা লইয়াই থাকি। অমিতাভ কায়সার আমার বন্ধু, শহিদ শহীদুল্লাহ কায়সারের ছেলে। ওর মা পান্না কায়সার রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে খুব এ্যাক্টিভ। ছেলের বন্ধু শুধু নয় কবিতা পরিষদ সুত্রেই আমার লগে বেজায় খাতির। অমির বোন শমী কায়সারতো তখন আমগো প্রজন্মের হার্টথ্রব তারকা। ওদের ইস্কাটনের বাসায় প্রায়শই আমাদের আড্ডা বয়। শমী আপু ও আড্ডার অবিচ্ছেদ্য একজন, ভাষা স্ল্যাং হইলেও সমস্যা নাই। শমী আপু আমাদের সবাইকেই তুই বলে ডাকতো, আর আমরা তুমি। হোস্টেলের কয়েন বক্স থেইকা বিশেষ কায়দায় কোন কয়েন খরচ না কইরা ফোন করতাম। অমিকে ফোন করলে মাঝে মাঝে শমী আপু ফোন ধরতো, প্রথম প্রথম ফোনে আমার নাম শুনলেই বলে উঠতো ‘ও, সুমন জাহিদ ভাই, আসসালামালাইকুম, কেমন আছেন?’ আমি ধমক দিতাম, ‘ফাইজলামী করো, অমিরে দেও।’ বেশ কয়েকবারই এরাম ঘটলো। তারপর মনে হইলো না এইটাতো ফাইজলামীর টোন না! একদিন আড্ডার মধ্যে আপুরে আসামী বানাইয়া ধরলাম, জিগাইলাম ‘কাহিনী কী? ফোনে আমারে আপনি মারাও ক্যা?’ ও বললো ‘নারে আমাদের এক বড় ভাই আছে, নামটা তোর মত, কন্ঠস্বরও প্রায় একই।’ খুব বেশি আর মাথা ঘামাইলাম না। এইটুকু বুঝলাম- হয়তো নাম বিভ্রাট।
এইবার আরো পিছে যাই। আমার পিতৃপ্রদত্ত আকীকাকৃত নাম মোঃ জাহিদুল ইসলাম ডাকনাম সুমন। ধর্মে নামকরণের উপর নাকি সুন্নতি বাধ্যবাধকতা আছে। উত্তমরূপে সুন্নত পালনার্থে নামের আগে মোঃ পরে ইসলাম লাগানো হালো। কিন্তু পরিচিতি তো ডাক নামেই। ‘সুমন’ নামটা এতটাই কমন যে ছোটকাল থেইকাই নামের কারণে নানান কিসিমের বিড়ম্বনা সইতে হইসে। শুধু আমার ক্লাশে আছে বেশ কয়টা সুমন। স্কুল, মহল্লা বা আমাদের ছোট্ট শহরটিতে সুমন আছে প্রায় কয়েক ডজন । আইডেন্টিটির সুবিধার্থে ক্লাসের বন্ধুরা আমাকে জাহিদ সুমন নামে ডাকতো। স্কুল পারাইয়া বিশাল এক স্বপ্ন লইয়া ভর্তি হইলাম ঢাকা কলেজে। কুয়ার ব্যাঙ গাঙে পড়লো। চোখের সামনে অজস্র পথ, সবগুলাই রঙিন; হাতছানি দিয়া ডাকে। বাউন্ডুলে মন সব পথেই উঁকি দিবার চায়। লেখক হইবার ব্যাপক বাসনা। মোঃ জাহিদুল ইসলাম বড়ই সেকেলে। এমনিতেই ধর্মীয় জ্ঞান বা ধর্মে-কর্মে আমার আগ্রহ কম অথচ নামের আগে পিছে হুদাই ধর্মীয় সিলমোহর তাও আবার ডবল!
হীনমন্যতাবোধ কি না জানি না তবে আধুনিক রুচি, মনন বা শ্রুতিমধুরতার সাথে নামটা সাংঘর্ষিক। বিশ্বব্যাপি নাম বদলের স্থানীয় সংস্কৃতি অতি প্রাচীন। বাংলাও ব্যতিক্রম নয়। সাহিত্যিক বা সাংবাদিকের বেলায় নাম বদল বা ছদ্ম নামের ব্যবহার শুরু থেকেই আছিল। তাই একদা স্কুলের ডাকনাম ‘জাহিদ সুমন’ উল্টাইয়া কলেজে আইসা ‘সুমন জাহিদ’ হইয়া গেলাম। কেউ কেউ বাহাবা দিল, কেউ নাক সিঁটকালো, আমি থোরাই কেয়ার!
১৯৯২ সালে গণআদালতের সময়ই হঠাৎ একদিন পত্রিকায় একটা লেখা চোখে পড়ছে। লেখক ‘সুমন জাহিদ চৌঃ’। শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের ছেলে, প্রজন্ম একাত্তরের সংগঠক। মনে হইলো আকাশ ভাইঙ্গা মাথায় পড়ছে। স্বাধীন আত্মনিয়ন্ত্রিত ব্যতিক্রমী জীবনাচারের বাতিক আমার আজন্মের। ঢাকাই জীবনে যাতে নাম বিভ্রান্তিতে পড়তে না হয় এবং স্বাতন্ত্রতা ও নান্দিকতা বজায় থাকে সেজন্য কত চিন্তা-ভাবনা, গবেষণা কইরা পিতৃপ্রদত্ত আকীকাকৃত নাম মোঃ জাহিদুল ইসলাম-সুমন পাল্টাইয়া সুমন জাহিদ হইছি সেইটা কারে বুঝামু। নাম চুরির মিথ্যা অপবাদও ভবিষ্যতে সইতে হইতে পারে তা ভাইবা আশংকিত হইলাম।
এরপর থেইকা মাঝে মাঝেই নামের কারণে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হইসে। দীর্ঘদিনের পরিচিত আপনজনও অনেকে এই ভুলটা করসে। যেমন ৫/৭ বছর আগের কাহিনী। ছাত্রদলের একসময়কার জাদরেল নেতা, জিয়া হলের সিব্বির ভাই’র লগে অনেক বছর পর দেখা মতিঝিলে। দেখা মাত্রই হাত মিলাইয়া সিনা বাড়ইয়া খুব আন্তরিকভাবে বুকে চাইপা ধরলেন, কইললেন ‘সুমন তোরে যে আমি কত পছন্দ করি তা তুই জানো না।’ তার সাথে থাকা কয়েকজন ভদ্রলোকের সাথে খুবই গর্বিতভাবে আমারে পরিচয় করাইয়া দিলেন এইভাবে- ‘কী চিনছেন ওরে, কি বলেন? আসলেই চিনেন না? আরে এ হচ্ছে বিখ্যাত সুমন জাহিদ, আমার খুবই প্রিয় ছোটভাই। যদিও ছাত্রলীগ করে! খুবই মেধাবী ও ত্যাগী ছাত্রনেতা ছিল। সেই ঢাকা কলেজের প্রথম নির্বাচনে…। জানেন ওর মা-কে? ও তাও জানেন না!…..সুমন তোর মায়ের নামে যে রাস্তাটির নামকরণ করার কথা সেটা কতদূর রে?’
এরাম বিব্রত ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আমাকে প্রায়ই পড়তে হয়। তদুপরি ‘সুমন জাহিদ চৌ:’ ভদ্রলোক ইদানিং তার নামশেষে চৌধুরী পদবীটি পরিত্যাগ করেছেন। ভেজাল না কইমা বাড়তে লাগলো। গত কয়েক বছর ধইরা ১৪ ডিসেম্বর আইলেই টিভি চ্যানেলারা ফোন দিতো। পরপর তিন বছর সেইম কাহিনী ঘটসে। ইতোমধ্যেই কয়েকজন দোস্তের বাড়তি পাড়াপাড়িতে, চরম অনিচ্ছা সত্বেও ছোট পর্দায় আমার ডেবু হইসে। মানে ৩/৪ খান টকশোতে অংশ নিতে হইসে। বছর দুই আগে এক কোকিল কন্ঠি ফোন কইরা কইলো, ‘আজ শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবসে রাতের টকশোতে আপনাকে একটু আসতে হবে। …অমুক ভাই আমাকে বলেছেন ফোন দিতে।’ ‘কইলাম ‘আর ইউ শিওর?’ ‘অবশ্যই শিওর। যাবার সময় আমাদের গাড়ি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।’ কইলাম, ‘ঠিকাসে! কিন্তু একটা কথা মনে রাইখেন,-আমার মা কইলো এখনও মরে নায়।’ আমতা আমতা কইরা ফোন রাইখা দিলেন। গত বছর আরেক চ্যানেল থেকে এক মাইয়া খুব ন্যাকোমি কইরা কইলো, ‘ভাইয়া ভালো আছেন? অমুক চ্যানেল থেকে তমুক বলছি। আপনারতো আজ অনেক প্রোগ্রাম-অনেক ব্যস্ততা জানি, তবুও রাত ১১ টায় একটু সময় দেন না?’ শালীর বেটিরে কইতে ইচ্ছা করছিলো ‘হ আইতাসি, বিছানা রেডি কর!’
ব্যক্তিগত জীবনে আমার জীবনাচরণ খুবই ফ্লাক্সিবেল, আনপ্রেডিক্টাবল। পৃথিবীর প্রায় সকল বিষয়েই আমার অদম্য আগ্রহ। বিশেষ করে ‘মানুষের যাপিত জীবন ও তার ভাবনা’ আমার প্রিয় বিষয়। পৃথিবীতে জীবিত শুধু ৭০০কোটি মানুষই নয়, এ যাবত পয়দাকৃত যত আদম সন্তান দুনিয়ায় আইছে এবং আইবো প্রত্যেকটা মানুষেরই খোমাখাতা এক একটা মহাকাব্য, সবগুলোই নিবিড়ভাবে পড়তে মুঞ্চায়। এরই ধারাবাহিকতায় বাঙালি মুসলমানের নাম ও নামের বিবর্তন নিয়া আমার আগ্রহ প্রচুর। তাই সুযোগ পাইলে গোরস্তান বা শ্মশানে গিয়া কবরের গায়ে খোদিত মৃত ব্যক্তির নাম নিবিড়ভাবে দেখে বিবর্তনের ধারাটি বোঝার চেষ্টা করি।
বাঙালি মুসলমানের নামের আগে ‘মোহম্মদ’, শ্যাষে ‘আহম্মদ’ বা ‘ইসলাম’ যোগ করার স্বয়ংক্রিয় রীতিটির সূচনা কবে, ক্যামনে শুরু হইলো এটা আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোরানিক কারণটাই যে মুখ্য না তা বেশ বোঝা যায় অন্যান্য মুসলিম দেশের নাগরিকদের নাম দেইখা। প্রাক মোগলযুগ থেকে বৃটিশপূর্ব সময় পর্যন্ত বঙ্গদেশে মুসলিম শাসন থাকলেও প্রান্তিক জনপদের ভূমিসন্তানরা ইসলামের শিকড়কে আগাছা বইলাই মনে করসে । উপনিবেশিক মর্ডানিজমের ঔরসে, ফোর্ট উইলিয়াম ধাত্রীর শুশ্রুষায়, ইয়ংবেঙ্গল এক্টিভিজম বা কলকাতার বাবু সংস্কৃতির গর্ভে যে বাঙালি সংস্কৃতির জন্ম তা বাঙালিত্বের আসল রূপ নয়। উহাকে অনেকে ‘বাঙালির রেনেসাঁস’ ভাবলেও বাঙালি মুসলমান তা একপ্রকারের প্রত্যাখ্যানই করসে। উপনেবিশক যুগের সূচনালগ্ন থেইকা মুসলমানরা ছিল নিপীড়িত ও সংগ্রামশীল, যারা নানা জাতের-নানা বর্ণের সনাতন বা মডার্ন ব্রম্মের নিগ্রেহের ধাক্কায় মুসলমানে রূপান্তরিত হওয়ার মধ্য দিয়া বিচিত্র ধর্ম-দর্শন-সংস্কৃতির অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হইয়া পথ চলতেছে।
১৮২০ সালের পর থেইকা হাজি শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজী আন্দোলনের মধ্য দিয়া নামাজ, রোজা, সুরা শেখার পর প্রথম ইসলামি শরিয়ত বা রিচুয়াল চর্চা শুরু হয়। বঙ্গ-ভারতের মুসলিম সন্তানের নামকরণে এই অভূতপূর্ব স্বয়ংক্রিয় রীতিটির প্রচলন বোধ করি তখন থেইকা। হিন্দুদের নামের আগে ‘শ্রী’ শব্দের অনুকরণে মুসলমানগণও ধর্মীয় স্বাতন্ত্রতা রক্ষায় নামের মাথায় ‘মোহাম্মদ’ আর মুসলমানিত্ব আরো পোক্ত করতে পাছায় যুক্ত করলো আহম্মদ বা ইসলাম। প্রজন্মের ব্যবধানে, ইতিহাসের পথে পথে বাঙালি মুসলমানের পথচলা প্রতিটি বাঁকে আইসা নতুন মাত্রা পাইসে। অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের ন্যায় চেইঞ্জ আইছে নামকরণেও, যদিও মুসলিম মানসের কাঙ্খিত প্রত্যাশার কানাকড়িও পূর্ণ হয় নায় কখনও। বিবেকের দন্ডে ধর্মীয় কনডম লাগাইয়া যতই কর্ষণ করুক সৃষ্টিশীলতা বা চিন্তার ছাও-পোনা জন্মানোর প্রচেষ্টা নিরর্থক। সুতরং সেই চেইঞ্জও উষর মরুর চৌহদ্দি পার হইতে পারে নায়। বড়জোর বাদশাহর পোলা নামের আগায় মোহম্মদ ফালাইয়া ‘গোলাম’ আর শেষে ‘হোসেন’ হইসে!
প্রজন্মের হিসাবে নিজেরে যদি স্বাধীন দেশের প্রথম প্রজন্ম ধরি তবে বাঙালি ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম আমার পিতাগণ। তারও প্রো-পিতাগণ বড় আশা নিয়া একবার বঙ্গভঙ্গ আরেকবার দেশভাগ করিয়া মুক্তি খুঁজিয়াছেন। ধর্ম শুধু আফিমের ন্যায় মোহগ্রস্থ কইরা রাখছিল আমার পূর্বপুরুষদের, রক্তজ ভ্রাতৃত্ববোধের চেয়ে মুসলিম ব্রাদারহুডকে প্রাধান্য দিয়া যে ভুল তারা করেছিল তার খেসারত দিসে আমার পিতাগন অনেক মূল্যের বিনিময়ে, দেশটাকে স্বাধীন কইরা। যার সবচে’ বড় বেনিফিশেয়ারি আমরাই। উই আর সিম্পলি বেলেস্ড। বাঙালি মুসলমানের এই ঐতিহাসিক যাত্রায় আমরাই একমাত্র প্রজন্ম যারা মরুময় ইসলামের প্রেমময় উত্তরাধিকার যারা দুর্বোধ্য আরবীতে নয় মনোহর মাতৃভাষায় আত্মপরিচয় বিনির্মানের সুযোগ পাইসি। একাবিংশতে আইয়া পরবর্তি প্রজন্ম সেই পুরানা ধর্মীয় কলে আবার আটকা খাইলো। এবার আর শুধু বাঙালি মুসলমান নয়, কনডম এবার ছিপি হইয়া বিশ্বব্যাপি মুসলমানদের চোখ-নাক-কান তথা বিবেক-বুদ্ধি চেন্তা-চেতনাকে বোতলবন্দি কইরা ফেলসে।
জঙ্গীবাদের উত্থানই কেবল নয়, নানা কারণে বাঙালির মুসলমানত্ব হঠাৎ কইরা তীব্র হইতাসে, তবে মোড়কটি এইবার ব্যতিক্রমী। যার প্রমান দেখা যায় শিশুর নামকরণে। স্বাধীন দেশে বাঙালি শিশুর নাম মরুপ্রান্তর ছাড়িয়া বাংলা হওয়া শুরু করছিল, কিন্তু ইসলামী মডার্নিজমের ধাক্কায় একবিংশ শতাব্দিতে আইসা আবার আরবীতেই ফেরত যাচ্ছে তবে কিছুটা আনকমন ওয়েতে। এইবার এমনসব আরবী শব্দ তীব্রভাবে আমদানী শুরু হইসে যা কস্মিনকালে আরবদেশেও শোনা যায় নায়। তোতা পাখিরমত শ্রুতিমধুর হইলেই হইলো, অর্থ অনৈসলামিক বা অমানুষ্যজাত হইলেও হুজুগে বাঙালির অনুধাবনের কোন চেষ্টা নাই।
ইসলামী জঙ্গিবাদের ভয়াবহতায় বিশ্বব্যাপি মুসলমানদের যে বদনাম ও তা থেকে জন্ম নেয়া সাবধানী নিরাপত্তাবোধে তাড়িত হইয়া রক্ষাকবচ হিসাবে সুমন জাহিদ নামটারেই নোটারী কইরা সরকারি কইরা লইছি। একমাত্র একাডেমিক সার্টিফিকেট ছাড়া সব জায়গাতেই সুমন জাহিদ। দুইযুগেরও অধিক সময় ধইরা বদল নামের চর্চায় কেতাবি নামটি এখন কতলপ্রায়।
বিগত বেশ কিছু বছর ধইরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ যুথবদ্ধভাবে ‘রক্তে রাঙা বিজয় আমার’ শিরোণামে তিনদিনব্যাপি বিজয় উৎসব উদযাপন করে, যা নতুনদের সাথে সাবেকদের একটা মেলবন্ধনও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ এই অনুষ্ঠান শুরু করে ১৪ ডিসেম্বর, ভিসি স্যারের বাড়ির সামনে রোড আইল্যান্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদদের নাম ফলকে মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়া। ভিসি স্যার ছাড়া শহীদ পরিবারের একজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয় তরুণদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার জন্য। কয়েক বছর আগে পোলাপানরে কইলাম এইবার আমন্ত্রণ জানা শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের সন্তান ‘সুমন জাহিদ’ কে। আমি ঢাকার বাইরে যামু কিন্তু তোরা পারলে তাকে আমার বিড়ম্বনার কথা জানাইস, যদি সম্ভব হয় তিনি যেন তার ‘চৌধুরী’ পদবীটি পুনর্বহাল করেন। আসলে আমি ঢাকায়ই ছিলাম, শরমে ঐদিন ক্যাম্পাসে যাই নাই। ভদ্রলোক নাকি বেশ ইন্ট্রোভার্ট ও স্বল্পভাষি। সবকিছু শুইনা একটু মিচকি হাসি দিছিলেন মাত্র। তার কোনো ফেবু একাউন্টও ছিল না কিন্তু কয়েকদিন আগে ফেসবুকে তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাই। আহ্লাদিত হইলাম। অনেক আশান্বিত হইয়া তার প্রোফাইল ঘাটলাম। বুঝলাম এখনও তিনি ফেবুতে অভ্যস্ত হন নাই, প্রোফাইল প্রায় ফকফকা।
এইবার আই বর্তমানে । বিয়া করসি ২০০৮ সালে, বউর ভাষায় বুইড়া বয়সে। । দুইমাস প্রেম কইরা বিয়া। কাকতালীয় বিষয় হচ্ছে বউর নাম সুমনা। অনেকেই ভাবে শালা একটা চাঁপাবাজ। সুমন নামের লগে মিলাইয়া বউর নাম নিজেই রাখসে, কেননা মর্ডানিজমের মোহে, শুদ্রের ভদ্রযাত্রায় পিতৃপ্রদত্ত নামে ছুরি চালাইয়া মফস্বলিকে কালচারাললি জাতোত্তীর্ণ করতে সে পারঙ্গম। শত্রুরূপি দোস্ত-বন্ধু যারা দাওয়াতি ছিল সবাইরে কাবিননামার সময়ই সাক্ষি রাখসি। সততায় মুগ্ধ হইয়া তাহারা শুধু বিয়াই খাইছে, বিয়ার চায় নায়!
এরপর বছর ঘুরতেই আমার আউলা-ঝাউলা শঙ্খনীল কারাগার আলোকিত কইরা একটা পুত্র সন্তান আইলো। সুমন জাহিদ পিতা হইলো! ঝামেলা বাঁধলো নবজাতকের নামকরণে। নামকরণে অ-আরবী শব্দ মানেই অধর্ম। সুতরং কোরান-হাদিসের দোহাই দিয়া পারিবারিক লিগ্যাসি বাস্তবায়নের নানা প্রকারের চেষ্টা তদ্বির শুরু হইলো। জ্বীনগত ধারাবাহিকতায় বরিশাইল্লা ঘাউরামী আমার মধ্যেও কম থাকার কোন কারণ নাই। নাম বাংলায়ই রাখুম। সুমন-সুমনার ছেলের নাম রাখা হইলো ‘মন’। কেতাবী নাম ‘বারিদ জাহিদ’। কিন্তু মনকে বিভিন্ন নিকট আত্মীয় পরিজন তাদের দেয়া নামেই ডাকে এবং তার সংখ্যাও একাধিক। আমার কোন ভাবান্তর নাই, উল্টা ইনজয় করি।
দোস্তরা ফোনে জিগায় ‘দোস্ শইলডা ভালো?’ কই ‘আগের নাহান!’ ‘মন ডা?’ ‘মনতো ফূর্তিতেই থাকে!’ যে যার মত বোঝে, বুঝুক। মনকে বুঝতে চাইলে টিএসসিতে আইতে হবে, মন ভালো না হইলে পয়সা ফেরত। শুধু একটা উদাহরণ দেই, টিএসসি এককালে ছিল আমার সেকেন্ড হোম, টিএসসিকেন্দ্রিক সব কিছিমের মানুষের আমি নিকটাত্মীয়, সবকিছুর মধ্যেই ওউনারশীপ ফিল করতাম। সামান্য কয়েক বছরের ব্যবধান, অথচ টিএসসি এখন আমাকে নিজ নামে যতটুকু চিনে তারও বেশি চিনে মনের বাপ বইলা। মাত্র দুই বছর বয়স থেকেই মন চলচ্চিত্র সংসদ বা শ্লোগান ৭১’র পোলাপানের কাঁধে কাঁধে চইড়া বেড়ায়। টিএসসিতে মনকে বিকালে ছাড়লে আমি কোলে পাই ফেরার সময়, তা সে যত রাতই হোক। এমনকি তীব্র শীতে সুইমিংপুলের বারান্দায় সে রাত কাটাইসে ৪ বছর বয়সে, বড় পর্দায় গ্যাছে বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালের সময়।
আগে প্রায়শ:ই একটা কথা কইতাম: ‘ছোটকালে পোলাপান বাপের হাতে মাইর খাইতো সুমনের লগে চলে বইলা, আর এই মাঝ বয়সে এখন খায় বউর হাতে, ঐ একই অপরাধে!’ পোলা বাপকেও টপকাইসে। ভর্তি হইসে সেন্ট গ্রেগরিতে। মহল্লার অনেকেই পড়ে ঐ স্কুলে। আমার বাসার ঠিক পাশ থেইকা ৪খানা গাড়ি যায় সেই স্কুলে সেইম টাইমে। তিনজন গাড়িওয়ালাই আমার নিকটাত্মীয় বা অকৃত্রিম শুভাকাংখি। একজনের ছেলে এবার চান্স পাইসে বইলা নতুন গাড়িও কেনসে এবং আমারে স্বেচ্ছায় কইছিলো, ‘মনরে স্কুলে নেয়ার জন্য আপনার আর কোন টেনশন করতে হবে না।’ ওমা! দিন যায়, তাগো সব ক্রাইসিস নিয়া নিত্য পরামর্শ করে আমার লগে, মাগার স্কুল বিষয়ক কোন কথাই সাইধা কয় না। কয়েক মাস যাওয়ার পর আমার মত বোধনাশার যখন বোধ আয় না, বউ তখন বুঝাইয়া দিল, ‘ওরা ছোটকালে না বুইঝা তোমার লগে মিইস্শা মাইর খাইসে, নিজের পোলার বেলায় রিস্কটা ওরা আর নেয় ক্যামনে! নিজের গাড়িতে মাইনষের বাচ্চারে লিফ্ট দিয়া নিজেরটা নষ্ট করবে ক্যা?’ বুঝলাম স্বার্থক জনম আমার, স্বার্থক এ জন্ম দেয়াও।
কিন্তু এইবার মনে হয় ঝামেলায় ফাইসা গেলাম। এক্সিডেন্ট কিনা কইবার পারুম না-আমি আরেকখান পুত্র সন্তানের বাপ হইলাম। জন্ম পরবর্তি আচারণ পর্যবেক্ষণে বোঝা যায় মহামান্য নাকি আমারই ফটোকপি! পিতৃপরিচয় সনাক্ততে রামবলদও ডিএনএ টেস্টের কথা মুখে আনবো না। মহামান্যের বয়স ইতোমধ্যেই বছর পার হইয়াছে। এইবার সমুদ্র সঙ্গমে গিয়া সৈকতে ফানুস উড়াইয়া নি:খচ্চায় তার প্রথম জন্মদিন উদযাপন করলাম স্কুল বন্ধুগো লগে। কিন্তু এখনও তিনি অনামিকা। পরিবারের মুরুব্বি বা অন্যরা এবার আর নাম নিয়া আগাইয়া আসতেসে না। সুমন-সুমনা-মন….পরেরটা কী? বছরব্যাপি চেষ্টা কইরাও যুৎসই বা মিলমতো নাম খুঁইজা পাইতাসি না। আমার দোস্তরা ছোটটারে এখন ‘মন-২’ বইলা ডাকে। তাদের শোনাশুনি ‘মন্টু মিয়া’ স্টাবলিশ হইয়া যাইতেসে। দোস্তরা কেউ যদি পারো মোরে একটু উদ্ধার কর।
(লেখাটি ঢাকা কলেজ-৯১’র ৩য় পুনর্মিলনী উপলক্ষে বিপ্লব মোস্তাফিজ সম্পাদিত ‘ইচ্ছে ঘুড়ি অথবা কথিত স্মৃতি’ নামক স্মরণিকায় প্রকাশিত ও ফেবু ভার্সনে কিঞ্চিত পরিমার্জিত।)