বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ড ও আমাদের পেশাদারিত্ব

35
2251

মধ্যবিত্তের মধ্যে পেশাদার শ্রেনীই হচ্ছে এর মূল চালিকাশক্তি। আধুনিক সভ্যতা ও তার বিকাশে তাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বায়নের এই যুগেও পেশাদারশ্রেনীটি যেকোন শ্রেণীর তুলনায় অনেকবেশী প্রিভিলাইজড শ্রেণীহিসেবে প্রতিষ্ঠিত। অপরিহার্যতা অস্বীকারের উপায়ও নেই। ষ্টাবলিষ্টমেন্টের ইদুরদৌড়ে নিজেদের আরোবেশী পেশাদার, আরোবেশী চৌকোষ করতে ব্যস্ত সবাই; কর্পোরেট কালচারের অভ্যস্ত হতে নিরন্তর চেষ্টারত সকলে। পেশাদারিত্বে মানবিকতার স্থান কোথায়! অ্যামেচারের মত ননপ্রফেশনাল কথা বললে কি আর হবে!

হায়রে আমাদের পেশাদারিত্ব! ডিসেম্বরের নয় তারিখ। ফটোজার্নলিষ্টদের পেশাদারিত্বের প্রাক্টিক্যাল পরীক্ষার সিট পড়েছে জগন্নাথ কলেজে। মৃত্যুকে হাতে নিয়ে জীবনের সর্ব্বোচ্চ দমটুকুর পুরোটা দিয়ে একজন যুবক দৌড়াচ্ছে বাঁচার জন্য। তার পিছনেই আট দশজন হিং¯্র যুবক ধারালো সব অস্ত্র নিয়ে উদ্ধত। সকলের সাথে সমন্তরালে আরো দৌড়াচ্ছে শতাধিক ফটোজার্নলিষ্ট; কেননা তাদের পরীক্ষা শুরু! প্লটটির ধরণ দেখেই তারা বুঝতে পারল এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হচ্ছে। তাই পারফরমেন্সটিও হতে হবে নিখুত ও মানোত্তীর্ণ। প্রতিরক্ষা বাহিনীর কোন মহড়াকে তারা কাভার করছে না; যা করছে পুরোটাই বাস্তব ও লাইফ। শট যেটি মিস তো মিস, রিটেইক করার কোন সুযোগ নাই। উপর্যোপরি চাপাতির আঘাতে যুবকটির সাদা কালো স্ট্রাইপের শার্টটি তখনো পুরোটা লাল হয়নি। দৌড়ে পালোনোর চেষ্টা করছে। দোতালার একটি ডেন্টাল ক্লিনিকের মধ্যে ঢুকেও রক্ষা পেলনা। সেখান থেকে যখন বেড়োলো টিভিতে লাইফ দেখাগেল শার্টটি রং তখন গাঢ় লালবর্ণের। কয়েকজন পরীক্ষার্থীর পেশাদারিত্বে চমকিত সবাই। ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরে ব্যক্তি জীবনে ডজনখানেক মৃত্যু আমি দেখেছি বেশ কাছ থেকেই। এত রক্তাক্ত শার্ট বোধকরি আসাদেরও ছিলনা। আমাদের সাংবাদিকরা আরো সাসপেন্সের আশায়! জীবনের শেষসুযোগ! এবার নরমুন্ড বিচ্ছিন্নহবারও একটা লাইফ শর্ট পেয়ে যেতে পারি। দোতলা থেকে আবার রাস্তায় দৌড় প্রতিযোগিতা। আমাদের দেশে সন্ত্রাসীরা পেশাদারিত্বের নিক্তিতে আগেই উত্তীর্ণ। তাদের কাজ খুব অল্পতেই শেষ। এবার অ্যামেচার সন্ত্রাসীরা রাজপথে পেটাচ্ছে যুবকটিকে। লাইফে দেখাগেল হাতে গোনা কয়েকজন সন্ত্রাসী! তাদেরকে ঘিরে আছে শতাধিক সংবাদ কর্মী। ফ্লাশলাইটের আলোয় বারবার আলোকিত হচ্ছে আমাদের প্রফেশনালিজম। তাদের কাছে এটা সাবজেক্ট। হোকনা মানুষ! হোকনা হিন্দু, মুসলমান, আওয়ামীলীগ, বিএনপি কিংবা রাজাকার তবুও তো সাব্জেক্ট! ননপ্রফেশনাল এ্যাটিচিউড হলে কী আর চলবে! আমরা বাঁচাতে যাব কেন? পুলিশের কাজটাওকি এখন আমাদের করতে হবে নাকি?

সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতা আর পেশাদারিত্বের ইতিহাস আর কয় দিনের। আমাদের পুলিশ বাহিনীতো বৃটিশ আমলের আগথেকই এটি শুধু পেশাদার শ্রেনী নয় পেশাদার বাহিনী। তার অভিজ্ঞতায় এটি কোন সামান্য ক্লাশটেস্টও নয়। আটপৌড়ে নিত্য অভিজ্ঞতা। শক্তিশালী চেইন অব কমান্ড তাদের। কমান্ডের মত রোবোটিক আচারণেই তাদের পেশাদারিত্ব নিশ্চিত হয়। কমান্ড আসুক তারপর দেখাবো এ্যাকশন কত প্রকার ও কি কি! আপাতত নিরাপদ দুরত্বেই বাদাম খাই।আমজনতার নাগরিকজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকার তো আর কারো নেই। এই ধরণের ঘটনায় মুহূতেই জনশূণ্য হয়ে যায় রাজপথ। দূর থেকে যতটা সম্ভব লোমহর্ষক নির্মম একটি ঘটনা দেখার দুর্লভ সুযোগ আমজনতা নেয় ঠিকই কিন্তু বিরল একটি অভিজ্ঞতা নিতে গিয়ে আবার যেতে আইনের স্বাক্ষী হতে না হয় সেদিকে তারা সদা সতর্ক।

শত শত সংবাদকর্মী আর পুলিশ! সবাই পেশাদার কিন্তু মানুষ হবার চেষ্টা একবারও কেউ করলোনা। অবশেষে মানুষ একজন এগিয়ে আসলো। রিপন নামের একজন রিক্সাওয়ালা। রিক্সাওয়ালারা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নয়। সুতরং পেশাদারিত্বের মর্ম আর বুঝবে কোথায়! ভাড়ার কথা থোরাই কেয়ার। রিপন নিজ দায়িত্বেই তাকে নিয়ে চললেন মিটফোর্ড হাসপাতালে।

এবার আসলেন সবচেয়ে পেশাদার শ্রেনী, জীবন মৃত্যুর জীয়ন কাঠি থাকে যার হাতে সেই অভিজ্ঞ চিকিৎসক সমাজ। টানা ২৫ মিনিটের ইন্টারভিউ। ক্যাজুয়ালিটি- এটা তো পুলিশম্যাটার। রিক্সাওয়ালার কেন? কিভাবে? কেস হয়েছে? কোন থানার কেস? আগে চাই পুলিশের ছাড়পত্র তারপর চিকিৎসা..ততক্ষণে আর একফোটা রক্তও রইলো না বিশ্বজিতের দেহে!

35 মন্তব্য

Comments are closed.